আন্তর্জাতিক ইতিহাসখ্যাত তিনজন নেতার ভাষণের অনুবাদঃ
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রঃ
(জানুয়ারী ১৯২৯ - এপ্রিল ১৯৬৮ খ্রীঃ)
‘আজ আমি আপনাদের সঙ্গে এমন এক সমাবেশে মিলিত হতে পেরে খুব খুশি হয়েছি। যা মুক্তিকামী মানুষের বৃহত্তম জমায়েত বলা যেতে পারে। একশ’ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু কালোরা আজও মুক্তি পেল না। বৈষম্য এবং বিচ্ছিন্নকরণের চক্রে পড়ে নিগ্রোদের জনজীবন আজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। একশ’ বছর পার হলেও আমেরিকার উন্নয়নে নিগ্রোরা আজও অথই মহাসাগরের মাঝে ক্ষুধার দ্বীপে বসবাস করে যাচ্ছে। তাই আমরা এখানে লজ্জাজনক পরিস্থিতির একটি নাটক মঞ্চায়ন করতে সমবেত হয়েছি।
বিলাসিতার সময় এখন নয়। গণতন্ত্রের দাবি বাস্তবায়নের সময় এখন। অন্ধকার ভেদ করে আলোর দিশারী হওয়ার মোক্ষম সময় এটি।
আমরা কেউ একা চলতে পারব না। আমাদের সবসময় একতাবদ্ধ হয়ে থাকতে হবে। অনেকেই আমাদের জিজ্ঞেস করেছে, আমরা কখন বাড়ি ফিরে যাব। আমরা নিশ্চুপ থাকি কী করে? যখন দেখি দীর্ঘপথ অতিক্রমের পর এ শহরের হোটেল এবং মোটেলগুলোতে আমাদের জন্য জায়গা হয় না। তখন আমাদের ব্যক্তিত্ব ধুলোয় মিশে যায় যখন দেখি হোটেল এবং মোটেলের দেয়ালে লেখা ‘শুধু শ্বেতাঙ্গদের জন্য’। আমরা কিভাবে সহ্য করি যেখানে মিসিসিপির নিগ্রোদের ভোটের অধিকার নেই। এভাবে ছোট ছোট লাঞ্ছনা থেকে বড় বড় লাঞ্ছনার দিকে আমাদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে। না না, আমরা খুশি নই। আমরা খুশি হতে পারি না।
সবাই এখানে আজ স্বাধীনতা এবং পুলিশি বর্বরতার বিরুদ্ধে কথা বলতে এসেছেন। আপনারা হলেন সৃষ্টিশীল দুর্দিনের বীর সেনানী। আপনারা কাজ চালিয়ে যাবেন এই বিশ্বাসের সঙ্গে যে এ অনাকাক্সিক্ষত কষ্টই আপনাদের মুক্তি এনে দেবে।
এতকিছুর পরও আমার একটা স্বপ্ন আছে। এমন একটা স্বপ্ন যার শেকড় আমেরিকার মূল স্বপ্নে আবদ্ধ। এ জাতি একদিন জেগে উঠবে এবং তার সত্যিকার আদর্শ অনুসরণ করবে। আমরা এই সত্যে বিশ্বাসী যে, পৃথিবীর সব মানুষকে সমানভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে।
একদিন জর্জিয়ার লালপাহাড়ে কৃতদাসের সন্তানেরা এবং তাদের মালিকেরা একত্রে ভ্রাতৃত্বের টেবিলে বসতে পারবে। আমার ছোট চার সন্তান এমন এক জাতিতে বাস করবে যেখানে তারা তাদের গাত্রবর্ণ দ্বারা মূল্যায়িত না হয়ে তারা তাদের চারিত্রিক উৎকর্ষ দ্বারা মূল্যায়িত হবে। আজকে আপনাদের কাছে আমি এই স্বপ্নগুলো নিয়ে হাজির হয়েছি। আমি স্বপ্ন নিয়ে এসেছি, একদিন অ্যালাবামায় ছোট ছোট কৃষ্ণাঙ্গ বালক-বালিকারা শ্বেতাঙ্গ বালক-বালিকাদের সঙ্গে হাত মেলাবে। ভাইবোনের মতো। একদিন প্রতিটি উপত্যকা উন্মুক্ত হবে।
মুক্তি আমাদের আসবেই। সেই দিন খুব বেশি দূরে নয়। সেদিন ঈশ্বরের সব সন্তান গেয়ে উঠবে- এ আমার দেশ- স্বাধীনতার স্বর্গভূমি।
সেদিন ঈশ্বরের প্রতিটি সন্তান, সাদা-কালো প্রত্যেকে একত্রে হাত রেখে প্রাচীন নিগ্রোদের প্রাণের সুরে বলব-অবশেষে আমরা মুক্ত! অবশেষে আমরা মুক্ত! সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। অবশেষে আমরা মুক্ত।’
আব্রাহাম লিংকনঃ
(১২ ফেব্রুয়ারী ১৮০৯ - এপ্রিল ১৫ ১৮৬৫)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট তিনি। ১৮৬১ সালে গৃহযুদ্ধকালে লিংকনের অবদানের কারণে দ্বিখণ্ডিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায় আমেরিকা। ১৮৬৩ সালের ১৮ নভেম্বর গেটিসবার্গে ভাষণ দিয়েছিলেন লিংকন। যা আমেরিকানদের মূল্যবান দলিল। ভাষণে তিনি বলেন-
‘আজ থেকে ৮৭ বছর আগের কথা। আমাদের পূর্বপুরুষরা একটি নতুন জাতির গোড়াপত্তন করেছিলেন। যে জাতি স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত এবং ‘সব মানুষ সমান’ এই নীতিতে উৎসর্গীকৃত। বর্তমানে আমরা বিরাট এক গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছি। যে যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পরীক্ষা করছি, এই নীতিতে দীক্ষিত ও উৎসর্গীকৃত ওই জাতি বা অন্য যে কোনো জাতি দীর্ঘকাল টিকে থাকতে পারে কি না। এই জাতি যাতে বেঁচে থাকতে পারে অনন্তকাল ধরে তার জন্য যারা এখানে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, তাদেরই এক অন্তিম আশ্রয়স্থলের একাংশকে উৎসর্গের উদ্দেশ্যে আমরা এখানে মিলিত হয়েছি। যেসব জীবিত এবং মৃত ব্যক্তি মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন, তারাই এই ভূমিকে পবিত্র করেছেন। সুতরাং এই পবিত্রতা হ্রাস করা আমাদের পক্ষের কাজ নয়। এখান থেকে আজ আমরা দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করব যাতে তাদের আত্মত্যাগ বৃথা হয়ে না যায়। যেন এই জাতি বিধাতার কৃপায় স্বাধীনতার নবজন্ম লাভ করে। জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা পরিচালিত সরকার ও জনগণের জন্য গঠিত সরকার যেন কখনও পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত না হয়।’
উইনস্টন চার্চিলঃ
(৩০নভেম্বর, ১৮৭৪-২৪ জানুয়ারী ১৯৬৫)
‘যারা এই সরকারে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন তাদের আমি বলেছি আর এই মহান সংসদকেও বলছি, দেয়ার মতো কিছুই নেই আমার, আছে শুধু রক্ত, কষ্ট, অশ্রু আর ঘাম। আমাদের সামনে অগ্নিপরীক্ষা, আমাদের মাসের পর মাস যুদ্ধ করতে হবে আর কষ্ট সহ্য করতে হবে।
তোমরা যদি জিজ্ঞেস করো, আমাদের নীতিমালা কী? তবে জেনে রাখো, আমাদের একটাই নীতি- জল, স্থল ও আকশপথে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। আমাদের সবটুকু সামর্থ্য আর ঈশ্বর প্রদত্ত শক্তি নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে এক নিষ্ঠুর দানবের বিরুদ্ধে। এটাই আমাদের নীতি।
যদি প্রশ্ন করো, আমাদের লক্ষ্য কী? তবে শুনে রাখো একমাত্র বিজয় ছাড়া আমাদের আর কোনো লক্ষ্য নেই। পথ যতই দীর্ঘ কিংবা কঠিন হোক, বিজয় ছাড়া আমরা অন্য কিছু ভাবছি না। বিজয় ছাড়া আমাদের কোনো পথ খোলা নেই।’
শাহ্ জালাল মাসিম
পলিটিকাল কনসালটেন্ট
ফাউন্ডার ও সি ই ও
স্কুল অব পলিটিক্স